সমকালের প্রতিবেদন...

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা: তিন কারণ সামনে রেখে তদন্ত

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল এমন কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সন্দেহভাজন হিসেবে গতকাল আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আগের দিন আরেকজনকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু কেন, কারা, কী কারণে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে থাকতে পারে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বের করতে পারেননি গোয়েন্দারা। তিনটি কারণ সামনে রেখে তদন্ত করছেন তারা। যারা হত্যা করেছে তারা মুহিবুল্লাহর পূর্বপরিচিত বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা।

তদন্ত সংশ্নিষ্টরা জানান, তিনটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো প্রত্যাবাসনের পক্ষ-বিপক্ষ। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করতেন। এজন্য তিনি কয়েকটি গ্রুপের বিরাগভাজন ছিলেন, যারা প্রত্যবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিত।

দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারে পথের কাঁটা ছিলেন মুহিবুল্লাহ। সেই গ্রুপগুলোর কোনোটি একক বা যৌথভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।

এ ছাড়া মাস চারেক আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করেন মুহিবুল্লাহ। ওই কমিটির মাধ্যমে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে জনমত গঠন ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলা হয়। ধারণা করা হয়, ক্যাম্পে ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহ ওই কমিটি গঠনের পর থেকে প্রত্যাবাসনবিরোধীরা তাকে নিশানা করে।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

মুহিবুল্লাহর সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী জামালিদা বেগম। মুহিবুল্লাহর সঙ্গে প্রত্যবাসনের পক্ষে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। জামালিদা সমকালকে যা জানালেন তার প্রমিত বাংলা এমন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুহিবুল্লাহ’র মতো ভালো মানুষ আর একজনও নেই। তিনি সবার ভালো-মন্দ দেখতেন। শুক্রবার সকালে সংগঠনের নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠকের ডাক দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। সেখানে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি ও কীভাবে নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া যায় তার কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল।’

রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে। তাদের অর্থের বড় উৎস ইয়াবা কারবার ও স্বর্ণ চোরাচালান। যেভাবে রোহিঙ্গারা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াচ্ছে এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আমরাও শঙ্কিত। কখন না এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্যাম্পের বাইরে চলে আসে। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশি-বিদেশি কারা রোহিঙ্গাদের ফুঁসলিয়ে মিয়ানমারে যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে, তাদেরও খুঁজে বের করা দরকার।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি যুক্ত ছিল তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হত্যার কারণ ও খুনিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। আবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি গ্রুপ রয়েছে যারা ক্যাম্পের অপর পক্ষকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। তারা মনে করে, ওই পক্ষটি বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্যাম্পের নানা তথ্য মিয়ানমারে পাচার করছে। যারা তথ্য পাচার করছে বলে সন্দেহ করা হয় তারা ‘কাফের’ হিসেবে পরিচিত।

আরও এক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাস চারেক আগে মুহিবুল্লাহ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বিভিন্ন ক্যাম্পে যে কমিটি গঠন করেছিলেন, তা ভালোভাবে নেয়নি প্রত্যাবাসনবিরোধী সশস্ত্র গ্রুপগুলো। ওই ঘটনার পর দেশ-বিদেশ থেকে মুহিবুল্লাহকে নানা ধরনের হুমকিও দেওয়া হয়। প্রত্যাবাসন নিয়ে তাকে বাড়াবাড়ি না করতে হুঁশিয়ারি দেয় কেউ কেউ।

আরও দু’জন গ্রেপ্তার: মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে এপিবিএন। তারা হলো- জিয়াউর রহমান ও আব্দুস সালাম। শুক্রবার মধ্যরাতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একটি দল উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। আটক দু’জনকে রাতেই উখিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এর আগে শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে এপিবিএনের সদস্যরা মোহাম্মদ সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম নামে একজনকে আটক করেছিলেন। পরে তাকে উখিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে দু’জনকে রিমান্ডে নিতে গতকাল আদালতে আবেদন করেছে পুলিশ।

বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা মুহিবুল্লাহকে নিজ অফিসে ৫ রাউন্ড গুলি করে। খবর পেয়ে এপিবিএন সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে ‘এমএসএফ’ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের ভাই হাবিবুল্লাহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন।

নিহতের ভাই হাবিবুল্লাহ প্রথমে এই হত্যার জন্য মিয়ানমারভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন আরসাকে দায়ী করেন। তবে উখিয়া থানায় করা মামলার এজাহারে হত্যা মামলায় কাউকে আসামি না করে কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রুপের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, আরসার পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে হত্যাকাণ্ডে তারা জড়িত নয় বলে দাবি করে।

২৭ সংগঠনের বিবৃতি: মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ২৭টি আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সংগঠন। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা এই আহ্বান জানায়।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- আরাকান রোহিঙ্গা ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-অস্ট্রেলিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও), অস্ট্রেলিয়ান বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ব্রিটিশ রোহিঙ্গা কমিউনিটি ইন ইউকে, বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন-জাপান, কানাডিয়ান বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল (ইআরসি), রোহিঙ্গা অ্যাকশন আয়ারল্যান্ড, রোহিঙ্গা আমেরিকান সোসাইটি এবং রোহিঙ্গা সোসাইটি মালয়েশিয়া।

/সমকাল